তারিখ : ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

গাজীপুরে বন কর্মকর্তাদের সহযোগীতায় বনাঞ্চলের মাটি চুড়ির হিড়িক

গাজীপুরে বন কর্মকর্তাদের সহযোগীতায় বনাঞ্চলের মাটি চুড়ির হিড়িক
[ভালুকা ডট কম : ২৮ মার্চ]
গাছকাটা ও পাচারসহ বনভূমি দখলবাজির কারণে অনেক আগেই গাজীপুরের শালবন ধ্বংসের প্রায় শেষ সীমানায় গিয়ে পৌঁছে। অবশিষ্ট বনাঞ্চলজুড়ে এবার চলছে মাটি চুরির মহোৎসব। রাক্ষুসে মাটিচোরচক্রের সদস্যরা রাতের আঁধারে বনাঞ্চলে এক্সকেভেটর দিয়ে কেটে নিচ্ছে মাটি। চোর চক্রের সদস্যরা চুরির ওই মাটি সিরামিক কারখানাসহ নির্মীয়মাণ বিভিন্ন কারখানা ও ইটখোলায় চড়াদরে বিক্রি করছে। বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা মাটি চুরির ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাটি চোর চক্রের সদস্যরা বনাঞ্চলের সুবিধা মাফিক স্থান বেছে নিয়ে প্রথমে গাছ কেটে সাবাড় করে। পরে ওই কাটা গাছের গোড়া উৎপাটন করে বনাঞ্চলে আগুন দেয়। এরপর আগুনে পুড়ে যাওয়া ছাই সরিয়ে শুরু হয় মাটিকাটা। ১০ থেকে ২০ ফুট গর্ত করে একরের পর একর বনভূমির মাটি কেটে নেয় চোরচক্র। মাটি কেটে নেওয়ায় বনের ভেতর স্থানে স্থানে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গভীর গর্ত। যেন পুকুর বা খাল কাটা হয়েছে। ওই গর্তগুলোতে ভবিষ্যতেও বনায়ন সম্ভব নয়।

বনাঞ্চলে মাটিকাটা প্রসঙ্গে ঢাকা বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) বখতিয়ার নূর সিদ্দিকী বলেন, পরিস্থিতির কারণে অপরাধের ধরন পাল্টে। আগে গাছ কাটা ও দখলবাজি চললেও এখন মাটিচোরদের দৌরাত্ম শুরু হয়েছে। তবে মাটিকাটারোধে বন বিভাগের অভিযান চলছে। বন বিভাগের কোন কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করে জানান, গাছকাটা, পাচার ও বনভূমি দখলসহ বনাঞ্চলে দূষণ শালবনের ঐতিহ্য বিনষ্ট করেছে। গাছ কাটারোধসহ বনভূমি পুনরধিকার করে বাগানসৃজন ও সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে বন রক্ষার শেষ চেষ্টা চালায় বন বিভাগ। তদুপরি প্রতিনিয়ত গাছ সাবাড় করে মাটি কেটে নেওয়ার ফলে বনাঞ্চলের অস্তিত্বই থাকবে না।

সরেজমিন শ্রীপুরের বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গিয়ে মাটি চোরচক্রের চিত্র চোখে পড়ে। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নয়নপুর সড়কে পোশাইদ দোখালা এলাকায় রেনাটা মৎস্য খামারের পশ্চিম পাশে সিসি ডিবি সড়ক। মাত্র ২’শ গজ দূরে ওই সড়ক ঘেঁষা বিশাল স্তুপাকার মাটি। তিন পাশেই কয়েক একর বন ভূমিজুড়ে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। পাশের উত্তর পেলাইদ গ্রামের নিরীহ কৃষক আবদুল গফুর জানান, প্রায় তিন মাস আগেও এখানে অসংখ্য গাছপালা ছিল। কিন্তু মাটি চোরচক্রের সদস্যরা গাছ কেটে সাবাড় করে গোড়া উৎপাটন করে। পরে ঝোপ-ঝাড় পুড়িয়ে শুরু হয় মাটিকাটা। দু-তিনটি এক্সকেভেটর দিয়ে একযোগে মাটিকাটা হয়েছে। অনেক সময় দিনের বেলায় প্রকাশ্যে মাটিকাটা হলেও সরকারদলীয় নেতাকর্মীসহ প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় কেউ মুখ খোলেনি। মাটির স্তুপের পাশ দিয়ে দুটি সদ্য নির্মিত সরুপথ চলে গেছে বনের ভেতর। ডান পাশের পথে দেড়’শ গজ দূরে বিস্তীর্ণ গর্ত। গর্তের চার পাশে গাছের অসংখ্য গোড়া।

লাকড়ি কুড়াতে আসা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এক বৃদ্ধ জানান, গাছকাটার পর চোরচক্র গোড়াগুলো উৎপাটন করে গর্তের চারপাশও মাটিকাটার জন্য উপযুক্ত করছে। বাঁ পাশের সরুপথে এগোতেই চোখে পড়ে খালসদৃশ বিস্তীর্ণ গর্তের। বিশাল গর্তটির তিন পাশে বন বিভাগের সৃজিত আকাশমনি বাগান। পূর্ব পাশে ধানক্ষেত। পাশের উত্তর পেলাইদ গ্রামের কলেজছাত্র জাকির হোসেন জানান, মাসখানেক আগে চোরচক্র রাতের আঁধারে ওই বনভূমি থেকে মাটি কেটে নিয়েছে।

সাতখামাইর বনবিট অফিসার রইস উদ্দিন দাবি করেন, খালসদৃশ গর্তটি বনভূমি নয়। পাশের বরমী ইউনিয়নের সাতখামাইর গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম মাস্টার ওই জমির মালিক।

সত্যতা যাচাইয়ের জন্য যোগাযোগ করা হলে জাহাঙ্গীর আলম মাস্টার বলেন, বিশাল গর্তটির বেশিরভাগ জমির মালিক বন বিভাগ। বনভূমি ভেবে চোরচক্রের সদস্যরা আমার এক বিঘা জমি থেকেও মাটি কেটে নিয়ে গেছে।

তেলিহাটী ইউনিয়নের টেংরা শিশু পল্লী প্লাস মোড় থেকে বাদশানগর সড়কে আধা কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ পাশে বনের ভেতর সদ্যকাটা পুকুর। গ্রামের নিরীহ মুদি দোকানদার আলফাজ মিয়া জানান, দু-তিন সপ্তাহ আগে দুটি এক্সকেভেটর দিয়ে দিন-রাত মাটিকাটা হয়েছে।

সদ্যকাটা পুকুরের বাঁ পাশে পূর্ব দিকে বনের ভেতর নির্মিত দুটি সরুপথ। বাঁ পাশে পথটি ১’শ গজ দূরে গিয়ে নেমে গেছে বিস্তীর্ণ গর্তে। গর্তটি প্রায় ১৫ফুট গভীর। দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫০ ফুট, চওড়ায়ও প্রায় দৈর্ঘ্যরে সমান। গর্তের চারপাশে গাছপালা। মাত্র দেড়শ গজ দূরে খালসদৃশ মাটিকাটা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামের এক মুড়ি বিক্রেতা জানান, টানা দেড়-দুমাস ধরে এসব বনাঞ্চলের ভেতর মাটিকাটা হয়েছে। পাশের রঙ্গিলা, নয়নপুর, এমসি ও জৈনা বাজার এলাকায় কয়েকটি নির্মীয়মাণ কারখানায় চুরির ওই মাটি বিক্রি করা হয়েছে। বনভূমি থেকে কাটা মাটি ওইসব এলাকার কয়েকটি সিরামিক কারখানা, বরমী ও কাওরাইদ এলাকায় বিভিন্ন ইট খোলায়ও বিক্রি করে চোরচক্র।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই জানিয়েছেন, সাতখামাইর বনবিট এলাকাজুড়ে তেলিহাটী ইউনিয়নের তালতলী গ্রামের শহিদুল ইসলাম, জয়নাল হাজারী, উত্তর পেলাইদ গ্রামের শফিকুল ইসলাম, মুরগীর বাজার এলাকার জামান মিয়া, বরমী ইউনিয়নের পোশাইদ গ্রামের এনামুল হক ও আমির আলীর নেতৃত্বে ৭ থেকে ৮টি মাটি চোরচক্র রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চোর চক্রের দুসদস্য জানান, সিরামিক কারখানা ও ইট খোলাগুলোতে মাটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এছাড়া নির্মীয়মাণ কারখানাগুলোতে মাটি ফেলা হয়। শিল্পাঞ্চল হওয়ায় শ্রীপুরে মাটিও দুর্মূল্য। চড়া দাম হাঁকলেও নিজের জমি থেকে কেউ মাটি বিক্রি করে না। ফলে ব্যাপক চাহিদার কারণে তারা বনভূমি বেছে নিয়েছে। নির্বিঘœ মাটি কাটায় বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদেরও প্রলুব্ধ করেছে।

চোর চক্রের সদস্যরা আরো জানান, কারো সঙ্গে মাটি সরবরাহ করার চুক্তি হওয়ার পর তারা প্রথমে কাছের সুবিধামাফিক কোন বনাঞ্চল বেছে নেয়। পরে সংশ্লিষ্ট বন বিট কর্মকর্তার সঙ্গে তারা আরো একটি অলিখিত চুক্তি করেন। এরপর বেছে নেওয়া বনাঞ্চলে গাছপালা কেটে মাটি কাটার জন্য উপযুক্ত করা হয়। চুক্তি মাফিক বন বিট কর্মকর্তা প্রতি ট্রাকভর্তি মাটির জন্য ২০ভাগ টাকা পান। লেনদেনে হেরফের হলেই মাটি কাটারোধে অভিযান চালায় বন বিভাগের কর্মকর্তারা।

সরেজমিন ঘুরে সাতখামাইর বন বিটের পোশাইদ গ্রামের আমির আলীর বাড়ির পশ্চিম ও উত্তর পাশে, টেংরা, টেপিরবাড়ী ও দরগারচালা এলাকায় বনের ভেতর স্থানে স্থানে বিস্তীর্ণ গর্ত দেখা গেছে।

সিংড়াতলী বনবিটের বিন্দুবাড়ী, জিওসি এলাকায় প্রায় দেড় একর বনভূমি থেকে মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে। পাশের মাধখলা পূর্বপাড়া এলাকায় বনাঞ্চল থেকে মাটি কেটে পাশের নির্মীয়মাণ কারখানায় বিক্রি করেছে চোরচক্র। এছাড়া রাথুরা ও শিমলাপাড়া বনবিটের বিভিন্ন এলাকায় দুর্ধর্ষ মাটি চোরচক্রের রাক্ষুসে খাবলের গভীর ক্ষত চোখে পড়ে বনাঞ্চলজুড়ে।

শ্রীপুরের বনরক্ষা ও পরিবেশ আন্দোলনের নেতা আবদুর রশিদ জানান, ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ও চট্রগ্রামের পাহাড়ী বনাঞ্চলের পর দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বন ছিল মধুপুর শালবন। এটি দেশের মধ্যাঞ্চলীয় বনভূমি হিসেবেও পরিচিত। এর বিস্তৃতি গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার অংশজুড়ে। এক সময় শালবনের সীমানা রাজধানীর কাঁটাবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। জমিদারি স্বত্ব থেকে সরকারের হাতে আসার পর গত ৬১বছরে বনের আয়তন ও জীব বৈচিত্র কেবল ধ্বংসই হয়েছে। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, গাছকাটা, পাচার ও দখলবাজীর কারণে বনভূমি বিপন্ন ছিল। এখন মাটি কাটার ফলে স্থায়ীভাবে বনাঞ্চল নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ছে। বনাঞ্চল রক্ষায় এখনই সামাজিক আন্দোলন দরকার।

বনাঞ্চলে মাটি কাটার ঘটনা স্বীকার করে শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবু জাফর জানান, বনাঞ্চলে মাটিকাটা অপরাধ ঘটনাটি একেবারে একটি নতুন বিষয়। বিভিন্ন সময় অভিযানে মাটি চোরচক্রের ট্রাক জব্দসহ সদস্যদেরও আটক করা হয়েছে। গাছপালা সাবাড় করে মাটিকাটায় চলতি ২০১৫ সালে ১৯টি মামলা করা হয়েছে।

মাটি কাটায় চোরচক্রের সঙ্গে বন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ প্রসঙ্গে ঢাকা বনবিভাগের সহকারী বনসংরক্ষক (এসিএফ) মোখলেসুর রহমান বলেন, ঘটনার সঙ্গে বন বিভাগের কোন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা নয়, নির্লিপ্ততার অভিযোগও প্রমাণ হলে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।




সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই