তারিখ : ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

লুট হচ্ছে রায়গঞ্জের বিরাট শহরের প্রত্ন-সম্পদ

*তিন হাজার বছরের প্রাচীন স্মৃতিচিহ্ন বিলীন প্রায় *প্রত্ন এলাকা হিসাবে ঘোষণার দাবি এলাকাবাসীর
লুট হচ্ছে রায়গঞ্জের বিরাট শহরের প্রত্ন-সম্পদ
[ভালুকা ডট কম : ১৩ মে]
রায়গঞ্জে মহাভারত খ্যাত বিরাট রাজার রাজধানী প্রাচীন বিরাট শহরের প্রত্ন-সম্পদ লুট হয়ে যাচ্ছে। প্রায় তিন হাজার বছরের প্রাচীন ঐ শহরের ধ্বংসস্তুপের অর্ধশতাধিক ঢিবির (টিলা) মধ্যে অধিকাংশ ঢিবির স্মৃতিচিহ্ন ও প্রত্ন-সম্পদ ইতোমধ্যেই নিঃচিহ্ন হয়ে গেছে। দৃর্বৃত্তরা খোঁড়াখুঁড়ি করে  অধিকাংশ ঢিবি সমতল ভুমিতে রুপান্তর করে ফেলেছে। লুট করে নিয়ে গেছে ইট মাটি ও প্রাচীন স্থাপনার নানা সরঞ্জাম। সিংহভাগ জায়গা-জমি অনেকেই নানাভাবে ভোগ দখলও করছেন।  প্রয়োজনীয় প্রত্নতাত্মিক গবেষণা ও উৎখনন অভাবে এর শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু আর অবশিষ্ট থাকছে না। ফলে কোথায় কোথায় সেই ঢিবিগুলো ছিল তা সনাক্ত করাও এখন দুরূহ। বিশিষ্টব্যক্তিগণের ধারণা- প্রতিটি ঢিবির অন্তরালেই ছিল মাটির নিচে দেবে যাওয়া দালানকোটা ও অতি প্রাচীন প্রত্নতাত্মিক নির্দশন।

মহাভারতে বর্ণিত বিরাট রাজার রাজধানী শহর ছিল তৎকালীন প্রমত্তা করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে বর্তমান ধামাইনগর ও সোনাখাড় ইউনিয়নের প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। এছাড়াও এই এলাকায় প্রাচীন বিভিন্ন স্থাপনা এবং বৌদ্ধবিহারের স্মৃতিচিহ্ন ও ধ্বংসাবশেষ  নানাস্থানে ছড়িয়ে রয়েছে।

বিরাট শহরের কিঞ্চিৎ ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। এর মধ্যে ক্ষিরিতলা বুরুজ ও অর্জুণগড়সহ মাত্র কয়েকটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ শুধু দৃশ্যমান। অধিকাংশ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষই এখন নিশ্চিহ্ন। মহাভারত ও ঐতিহাসিকগণের উল্লিখিত তথ্যমতে- ছদ্মনামে পঞ্চপান্ডব দ্রৌপদীসহ একবছর কাল বিরাট রাজার আশ্রয়ে ছিলেন। জেষ্ঠ্য পান্ডব যুধিষ্ঠির কঙ্ক নাম ধারণ করে বিরাট রাজার সভাসদ হলেন। ভীম 'বল¬ব' নাম ধরে পাকশালার প্রধান হলেন। অর্জুন তৃতীয় লিংগ (নপুংশক) রূপে বৃহ্ননলা নাম ধরে রাজ কন্যা উত্তরার নৃত্য শিক্ষক হলেন। নকুল ছিলেন অশ্ব বিশেষজ্ঞ, তাই গ্রন্থিক নাম ধরে বিরাট রাজার অশ্বরক্ষক হলেন। সহদেব ছিলেন গো বিশেষজ্ঞ, তাই তন্তিপাল নাম ধরে গো শালার তত্ত্বাবধায়ক হলেন। দ্রৌপদী ছিলেন কেশ সংস্কারে (চুল বাঁধা) পটু, সৈরেন্ধ্রী নামে রাজমহিষী সুদেষ্ণার পরিচারিকা হলেন। [ ব্যাসকৃত মহাভারত সারানুবাদ রাজশেখর বসু: বিরাটপর্ব: পান্ডব প্রবেশপর্বাধ্যায়।]

ক্ষিরিতলা বুরুজ ঃ ধামাইনগর ইউনিয়নের ক্ষিরিতলা মৌজা ও নিমগাছি বাজারের আশে পাশে বেশ কয়েকটি স্থাপনার ধ্বংসস্তুপের কিঞ্চিৎ অস্তিত্ব এখনো চোখে পড়ে। এর মধ্যে অন্যতম ক্ষীরিতলা বুরুজ (বিরাট রাজার পোড়ো রাজবাড়ি)। বিশাল এলাকা জুড়ে ক্ষিরতলা বুরুজ অবস্থিত। সমতল ভূমির চেয়ে স্থানটি সুউচ্চ। একারণে  এলাকাবাসী এই স্থানকে বুরুজ (উঁচুস্থান বা দুর্গ) বলে থাকে। ক্ষিরতলা বুরুজের শীর্ষ স্থানে জন্ম নেয়া কালের স্বাক্ষী বিশাল পাকুড় গাছের ফাঁকে ফাঁকে এখনো দেখা যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজপ্রাসাদের কার্ণিশ। কতিপয় দুর্বৃত্ত গুপ্ত ধনের আশায় খোঁড়াখুঁড়ি করে এর বিপুল পরিমাণ ইট চুরি করে নিয়ে গেছে। জনশ্র“তি আছে স্বর্ণমুদ্রাসহ এখানে অনেকেই এখানে পেয়েছে অনেক কিছু।

ক্ষিরিতলা বুরুজ খনন ঃ এলাকাটি অরক্ষিত থাকায় ইতিপূর্বে কয়েকবার ক্ষিরিতলা বুরুজের স্থান খনিত হয়েছে। উপজেলার ঝাপড়া গ্রামের অধিবাসী জনৈক শীতল সাহা ধনরত্ন পাওয়ার আশায় বুরুজের একাংশে খনন করেছিলেন। সিরাজগঞ্জ মহকুমার ভুতপুর্ব মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ নোলন সাহেবের আমলে ও জমিদার বনওয়ারী লাল বাবুর সময়েও এই ক্ষিরিতলা বুরুজের স্থান একাধিকবার খনিত হয়েছিল। এসব অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খননের ফলে পোড়ো প্রাসাদটির প্রকৃত অবস্থার চরম ক্ষতি হয়েছে।

মহাভারত ও ঐতিহাসিকগণের মতে -কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে শক্তি সংগ্রহের নিমিত্ত পঞ্চপান্ডব বিরাট রাজার রাজ প্রাসাদে আশ্রয় গ্রহন করেছিলেন। ফকির বিদ্রোহের শীর্ষ নেতা ফকির মজনু শাহও শক্তি সংগ্রহ ও তার বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে চৌকস করে (১৭৭০-১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দ) বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য সুরক্ষিত আস্তানা গড়ে তোলেন বিরাট রাজার পোড়ো রাজমহল ক্ষিরিতলা বুরুজ এলাকায়। তখন দ্বীপের ন্যায় এলাকাটি গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। পুর্ণিয়ার প্রাদেশিক রাজস্ব বিভাগীয় কাউন্সিলের ১৭৮০ খিৃষ্টাব্দের ১৪ মার্চের রিপোর্ট থেকে এতথ্য জান গেছে। রাজমহল হতে নিমগাছি বাজার পর্যন্ত জলরাশি পরিবেষ্টিত ছিল। ক্ষিরিতলা জঙ্গল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে বৃটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ৪ বছরের অধিককাল যুদ্ধ পরিচালনা করেন ফকির মজনু শাহ্। তার বাহিনীর বিদ্রোহীরা ১৭৭১ সালে বৃটিশের আজ্ঞাবহ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মহারাজের পুর্ব পুরুষ শ্রী চন্দ্র শেখর আচার্যকে ময়মনসিংহ থেকে বন্দী করে এনে বিরাট রাজার জঙ্গলাকীর্ণ ঐ পোড়ো রাজমহলে কিছুদিন আটক করে রাখেন। পরে ১৭৭৬ খিৃষ্টাব্দে ফকির মজনু শাহ বগুড়া জেলার মহাস্থানে আরো একটি দুর্গ গড়ে তোলেন। ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুন বগুড়া জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ ফ্রান্সিস গ্লাডউইন কর্তৃক দিনাজপুর রাজস্ব কাউন্সিলে প্রেরিত রিপোর্টে শাহ মস্তান ফকির দলের অত্যাচার (ইংরেজদের ভাষায়) ও ঐ দুর্গের কথা উল্লেখ আছে।

এছাড়াও  ঐ এলাকায় রয়েছে অতি প্রাচীন ও বৃহৎ জলাশয় জয়সাগর, প্রতাপদীঘি, উদয়দীঘি, শৈলা দীঘি, ডেবরা দীঘি, কমল খাঁ দীঘি, কাতলা দীঘি ইত্যাদি। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে দীঘিগুলো রাজা দ্বিতীয় গোপাল পালের রাজত্বকালে (৯২০-৯৪০ খ্রীঃ) খনন করা হতে পারে। অপরদিকে আব্দুল হামিদ টিকে কৃত চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে বল্লাল সেন বংশীয় রাজা  অচ্যূত সেন পারলৌকিক ফল প্রত্যাশায় জয়সাগর দীঘিসহ ৪টি দীঘি খনন করেন। ভৃত্য উদয়ের নামে উদয় দীঘি, সেনাপতি প্রতাপের নামে প্রতাপদীঘি ও রাজকুমারী ভদ্রাদেবীর নামে ভদ্রাদীঘি খনন করেন।

অর্জুণগড় ঃ টিলার মত একটি সুউচ্চস্থান। এখানে বর্তমানে দুর্গা মন্দির ও আশ্রম রয়েছে। স্থানটি ২নং সোনাখাড়া ইউনিয়নের অর্ন্তত। সোনাখাড়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় হতে উত্তর দিকে কাঁচাপাকা সড়ক পথে প্রায় ৩ কিঃমিঃ দুরত্বে অর্জুণগড় মন্দির ও আশ্রম অবস্থিত। ক্ষিরিতলা বুরুজের প্রায় ১ কিঃমিঃ দক্ষিণ দিকে নিমগাছি ধামাইনগর সড়কের লাগোয়া পশ্চিম পার্শ্বে এই অর্জুণগড়। মহাভারত গ্রন্থ মতে পঞ্চ পান্ডবের দ্বিতীয় পান্ডব অর্জুণ বৃহ্ননলার ছদ্মবেশে (নপুংশক) ঐস্থানে অবস্থিত বিরাট রাজার নৃত্যশালায় নৃত্য-গীতের শিক্ষক হিসাবে এক বছরকাল দায়িত্ব পালন করেছেন। তার নামানুসারে পরবর্তীকালে ঐস্থানের নাম হয় অর্জুণগড়। এর সুদীর্ঘকাল পরে জমিদার নবীন কিশোর চৌধুরী ঐস্থানে জয়দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠাসহ একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। সেবাইত নিয়োগ হন সরোজু বালা চৌধুরাণী। এই আশ্রম ও মন্দিরের দেবোত্তর প্রায় ৩০ একর সম্পত্তি এলাকার প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে ভোগ দখল করছে বলে জানাযায়।

কাঞ্চনস্বর ঃ এখানে তাড়াশ থানার মাধাইনগর ইউনিয়নের একটি ছোট্ট বাজার অবস্থিত। বর্তমান কাঞ্চণস্বর কিচনশহর নামের অপভ্রংশ বলে অনেকে দাবি করেন। দ্রৌপদীকে কুৎসিত প্রস্তাব করার প্রতিবাদে ভীম বিরাট রাজার শ্যালক ও সেনাপতি কিচককে গদাঘাত করতে করতে তাড়িয়ে নিয়ে ঐস্থানে বধ করেছিলেন বলে প্রবীনব্যক্তিদের কথিত সূত্রে জানাযায়। একারণে ওই স্থানের নাম কিচনশহর নামে খ্যাত হয়। এছাড়াও মরা করতোয়ার একটি খাতকে কিচকখালি বলা হয়।

খৃষ্টপুর্ব ৫শ’ অব্দেরও আগে থেকে এই এলাকা বিরাট রাজার রাজত্বের অর্ন্তভূক্ত ছিল বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা (এ্যাড. ফজলুর রহমান খাঁ কৃত সিরাজগঞ্জের ইতিহাস)। রাজ্যের নাম ছিল ‘মৎস্যদেশ’। বিশাল জল রাশির মাঝে দ্বীপের ন্যায় ছিল এই মৎস্যদেশের রাজধানী বিরাট শহর। ঐ শহরের তিন হাজার বছরের প্রাচীনত্ব ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। আমরা জানি গৌতম বুদ্ধ জন্ম গ্রহন করেন খৃষ্টপুর্ব ৫৬৭ অব্দে এবং দেহত্যাগ করেন খৃষ্টপুর্ব ৪৮৭ অব্দে ৮০ বছর বয়সে। বুদ্ধদেব যখন ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করছিলেন তখন হস্তিনাপুরে পান্ডবদের রাজত্ব  চলছিল বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রমতে জানাযায়। বৌদ্ধ ধর্মের পুর্বে আর্য ও বৈদিক (সনাতন) ধর্মের প্রচলন ছিল। গৌতমবুদ্ধ ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচারকালের কিছুকাল আগে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল বলে সহজেই অনুমান করা যায়। আর এরও আগে পঞ্চপান্ডব ছিলেন বিরাট রাজার আশ্রয়ে। অর্থাৎ নিঃসন্দেহে ইহা তিন হাজার বছর আগের ঘটনা। অতএব বিরাটনগরের বয়স তিন হাজার বছরেরও বেশি ইহাতে কোন সন্দেহ নাই।

অবস্থান ঃ রায়গঞ্জ উপজেলা সিরাজগঞ্জ সদর হতে প্রায় ৩০.০৪কিঃমিঃ পশ্চিমে অবস্থিত। একটি পুরাতন থানা ও প্রাচীন এলাকা হেতু এর কিছু কিছু এলাকার মাটি গৈরিক বর্ণের। এককালে এই এলাকায় অনেক বৌদ্ধমঠ ও বিহার ছিল। এখনও তার ইট-সুরকি ও মৃৎপাত্রের অংশ বিশেষ বিভিন্ন স্থানে মাটিতে মিশে আছে। সুদুর অতীতে রায়গঞ্জের নিমগাছিতে বিরাট রাজার কাছারি ও দক্ষিণ গো-গৃহ ছিল বলে জনশ্র“তি আছে। নিমগাছির চারিদিকে ছিল বিশাল জলরাশি পরিবেষ্টিত। প্রায় আড়াই শ’ বছর আগেও  নিমগাছি থেকে পাবনা জেলার দ্বোগাছি পর্যন্ত খেয়া নৌকায় পরাপার চলতো। নিমগাছির কয়েক কিঃ মিঃ উত্তরে ক্ষিরতলা বুরুজ অবস্থিত। ঐতিহাসিকদের মতে (সিরাজগঞ্জের ইতিহাস) এটাই ছিল মৎস্যদেশ অধিপতি বিরাট রাজার রাজমহল। রায়গঞ্জ উপজেলার ধামাইনগর বাজার হতে নিমগাছি বাজার পর্যন্ত চলামান সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে এর অবস্থান। ধামাইনগর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় (শালিয়াগাড়ি বাজার) থেকে ধামাইনগর বাজার প্রায় ৩ কিলোমিটার পুর্ব দিকে। ঐ বাজার থেকে নিমগাছি সড়কে প্রায় আড়াই কিঃ মিঃ দক্ষিণে সড়কের পুর্ব পাশ ঘেঁষে অবস্থিত কালের সাক্ষী বিরাট রাজার এই পোড়ো রাজমহল। রায়গঞ্জ উপজেলা সদর থেকে সিমলা-রানীরহাট সড়ক পথে উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের ষোল মাইল বাসষ্ট্যান্ড পার হয়ে পশ্চিম দিকে প্রায় ৪ কিঃ মিঃ পথ অতিক্রম করলেই ধামাইনগর বাজার।

অতি প্রাচীনকালে এই এলাকায় প্রবাহমান ছিল তিস্তা (ত্রিস্রোতা), করতোয়া, বাঙ্গালী (ফুলজোড়), আত্রাই (আত্রেয়ী), ইছামতি ও স্বরসতী প্রভৃতি নদী। তৎকালীন স্রোতঃস্বিনী করতোয়ার পশ্চিম তীরে গড়ে ওঠে বিরাট নগর। নানা প্রকার প্রাকৃতিক কারণে করতোয়ার গতি রূদ্ধ হয়ে যায়। এই খাতটি এখন মরা করতোয়া নামে পরিচিত।

বিরাট শহর ঃ বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানাযায়, বগুড়া জেলার শেরপুর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ও ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার অর্ন্তগত নিমগাছি নামক অতি প্রাচীন একটি স্থান আছে। এখানে প্রায় ১২ বর্গকিলোমিটার স্থান জুড়ে প্রাচীন কীর্তির অসংখ্য ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। জনপ্রবাদ ও মহাভারত গ্রন্থে উল্লিখিত মৎস্যদেশ অধিপতি বিরাট রাজার রাজধানী বলে অভিহিত করা হয় এবং সেই সূত্রে এস্থানের প্রচীন নাম বিরাট শহর বা বিরাট নগর। এর বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যে কয়েকটি স্থাপনার চিহ্ন অবশিষ্ট আছে তার মধ্যে বেশ ঊঁচু ও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্ষিরিতলা বুরুজ। সম্ভবত এটাই ছিল বিরাজ রাজার রাজ মহল। বিরাট রাজা শখের বশে ভিনদেশ থেকে দুর্লভ ৪ টি ক্ষিরিগাছ সংগ্রহ করেন। যা তার রাজ্যের ৪ স্থানে নিজ মহলের সামনে রোপন করা হয়েছিল। উক্ত বিরাট শহরের রাজবাড়ির সম্মুখভাগেও একটি ক্ষিরিগাছ ছিল বলে জনশ্রুতি আছে। একারণে স্থানটি ক্ষিরিতলা নামে পরিচিত।  নিমগাছির পুর্ব দিক দিয়ে একটি প্রাচীন ও সুবৃহৎ নদীর খাত দেখা যায়। সেই খাত ভরাট হয়ে এখন চাষের জমিতে পরিণত হয়েছে। এখান থেকে পুর্বদিকে পাকা সড়ক পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলে বালুকা মিশ্রিত পলি মাটির প্রধান্য দেখা যায়। এখাতের পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চল লালমাটিতে গঠিত। শেরপুরের দক্ষিণ থেকে করতোয়া নদীর একটি ধারা প্রাচীনকালে মির্জাপুরের দক্ষিণ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলা হয়ে রায়গঞ্জের নিমগাছি, ধামাইনগর, সোনাখাড়া, তাড়াশ উপজেলার অংশবিশেষ হয়ে পাবনার বিভিন্ন স্থান বিধৌত করে দক্ষিণে পদ্মাতে পতিত হয়েছে। বর্তমানে এই খাতটি মরা করতোয়া নামে পরিচিত। এই মরা করতোয়ার যৌবন কালেই এর তীরে গড়ে উঠেছিল বহুপ্রাচীন বিরাট শহর ও জনপদ বলে ধারণা করা যেতে পারে। নিমগাছি বাজার- বগুড়া জেলার ভবানীপুর রাস্তায় নিমগাছি থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার উত্তর থেকে দেড় কিলোমিটার পুর্ব পর্যন্ত রাস্তার নিচে স্থানে স্থানে অতীতে প্রাচীন ইট দেখা গেছে। এতে ধারণা করা যায় রাস্তাটি এককালে ইট দিয়ে বাঁধানো ছিল। হালে এর উপর দিয়ে পিচঢালা রাস্তা নির্মাণ হওয়ায় তা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছে। বাজারের দক্ষিণ যে রাস্তাটি পশ্চিম দিকে চলে গেছে তা ধরে প্রায় ১ কিলোমিটার পশ্চিমে গেলেই পাওয়া যাবে জয়সাগর দীঘি।  জয়সাগরের প্রায় ১০০ মিটার দক্ষিণে ছিল একটি ঢিবি। অন্ততঃ ২বিঘা ভূমির উপর অবস্থিত এ ঢিবির উচ্চতা ছিল প্রায় ৬ মিটার। এর লাগোয়া দক্ষিণেই ছিল আর একটি ঢিবি।  উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ এ ঢিবির আয়তন প্রায় ১একর, উচ্চতা ছিল প্রায় ৭মিটার। এর লাগোয়া দক্ষিণে ছিল তৃতীয় ঢিবিটি। এর আয়তন এক বিঘার বেশি নয়, উচ্চতাও প্রায় ৪ মিটার। প্রত্যেক ঢিবিতে প্রচুর প্রাচীন ইটের প্রশস্ত ভিত্তি প্রাচীর ছিল। ঢিবির চারদিকে অনেক প্রস্তর খন্ড ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বহুকাল দেখা গেছে। এইসব ঢিবির দক্ষিণ-পুর্বে আছে আধুনিক কালের একটি মসজিদ। মসজিদের পুর্বে এবং রাস্তা থেকে প্রায় ১৫ মিটার পুর্বে ছিল প্রাচীন ইট, পাথর ইত্যাদির ভগ্নাংশে একটি প্রায় সমতল ঢিবি। এতে প্রশস্ত দেয়ালে ভিত্তি চিহ্নও ছিল। মসজিদ থেকে প্রায় ১৫০ মিটার দক্ষিণে প্রাচীন ইটে পরিপুর্ণ একটি ঢিবি ছিল। লোকে এই ঢিবিকে বলতো ‘হাউরিয়া মোল্লার মাজার’। এই কথিত ধারণার সত্যতা কতটুকু তা বলা কঠিন। কেননা সেখানকার ইটগুলোর ধরণ দেখে মনে হয় এগুলি প্রাচীন হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের। এসব পুরাকিির্তর অধিকাংশইর এখন আর কোন চিহ্ন মাত্র নেই। সব লুট হয়ে গেছে। এলাকার প্রত্নতত্ব প্রেমী ও ইতিহাস অনুরক্ত বিশিষ্টব্যক্তিগণের দাবি জরুরী ভিত্তিতে এলাকাটি প্রত্ন এলাকা হিসাবে ঘোষণা করাসহ বিলুপ্তপ্রায় অবশিষ্ট স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ গুলো প্রত্নতাত্বিক গবেষণার নিমিত্ত প্রয়োজনীয় উৎখনন ব্যবন্থা করা। এতে প্রায় তিনহাজার বছরের প্রচীন ইতিহাস ও তৎকালীন সভ্যতার উম্মোচিত হলে ভারতবর্ষের সেরা অঞ্চল হিসাবে রায়গঞ্জের অবস্থান নির্ণয় হতে পারে।

সম্প্রতি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক রিফাত-উর-রহমানের নেতৃত্বে একটি দল নিমগাছিসহ ক্ষিরিতলা এলাকা পরিদর্শন করেন এবং বেশকিছু প্রত্নতাত্বিক নমুনা সংগ্রহ করেন। সুইডেনের লুনড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা প্রত্নতাত্ত্বিক মোঃ রিফাত-উর-রহমান ইত্তেফাককে বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অতীত সময়কে বোঝার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সূত্রের চেয়েও অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন প্রত্নবস্তুর উপরে। আমরা গত চার মাস এই এলাকা জরিপ করে ইট, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, মাটির নমুনা সংগ্রহ করেছি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন এবং প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া এই প্রত্নস্থলের সময়কাল সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবোনা। তবে প্রাপ্ত নমুনা থেকে আপাতদৃষ্টিতে এটি ধারণা করা যায় যে প্রাচীনকালে এটি একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। এই মুহুর্তে প্রত্নস্থলটি উৎখননের জন্য বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অনুমতি প্রয়োজন। উৎখননের অনুমতি পেলে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রত্নস্থল নিয়ে গবেষণা করতে প্রস্তুত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো এটি একটি অসংরক্ষিত প্রত্নস্থল। যতো দ্রুত সম্ভব প্রত্নস্থলটিকে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা জরুরী। অনুমতি সাপেক্ষে এখানে উৎখননের ব্যবস্থা করা গেলে সুদুর অতীতের অনেক বিষয় উন্মোচিত হবে। জানা যাবে ইতিহাস ঐতিহ্যের অনেক অজানা অধ্যায়। # 



সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই