তারিখ : ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

হায়রে! করোনা ভাইরাস

হায়রে! করোনা ভাইরাস
ভাই ভারী মনে হলে একটু নামিয়ে নিয়েন, তবু আব্বু যেন পরে না যায়!
[ভালুকা ডট কম : ০৩ জুন]
নওগাঁয় এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৪জন মারা গেছে। তাদের মধ্যে এক পুলিশ কর্মকর্তা, দুইজন ব্যবসায়ী ও একজন বন কর্মকর্তা। করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ দাফনে যেমন অনিহা দেখানো হচ্ছে তেমনি স্থানীয় ভাবেও কোন সহযোগীতা করা হচ্ছে না বলেও বিভিন্ন ভাবে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৃতের দাফন-কাফন ও সৎকারে সহযোগীতা করা হচ্ছে।

জেলার নিয়ামতপুরে সম্প্রতি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শফিউর রহমান (৫৫) নামে এক ব্যক্তি মারা যান। উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের পানিহারা গ্রামের মৃত- ওবাইদুল হকের ছেলে। তিনি কক্সবাজারে বন কর্মকর্তা ছিলেন বলে জানা গেছে। তার লাশ দাফনে স্থানীয় ভাবে যে অসহযোগীতা করা হয়েছে তা নিয়ে নিয়ামতপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জয়া মারিয়া পেরেরা তার ফেসবুক পেজে একটি পোষ্ট দিয়েছেন। তার আবেগঘন পোষ্টে এক বেদনাদায়ক স্মৃতি ফুটে উঠেছে।

পোষ্টে তিনি লিখেছেন- ‘করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া বন কর্মকর্তা শফিউর রহমানকে নিয়ামতপুরের রসুলপুর ইউনিয়নের পানিহারা গ্রামে তার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর বারটার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি কক্সবাজারে কর্মরত ছিলেন বলে জানা গেছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির দাফন সংক্রান্ত নির্দেশনা মেনে জানাজার নামাজ শেষে রাত ৯ টায় তাকে দাফন করা হয়। দাফন কার্যক্রমে সহায়তা করেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন।

নিয়ামতপুরে আজই প্রথম একজন করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফন সম্পন্ন হলো। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন লাশ নিয়ে রওনা হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগেই আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। তারা চারটি পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম), হ্যান্ড গ্লাভস আর মাস্ক চেয়েছিল। এগুলো কারও মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলেও চলতো। কিন্তু নিজে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেছিলাম দাফন কার্যক্রমে স্থানীয়ভাবে কোন বিঘ্ন হতে পারে আশংকা থেকে। এর আগে বিভিন্নভাবে জেনেছি করোনায় মারা যাওয়া মানুষের দাফনে স্বজনদের তীব্র অবহেলার কথা। নিজ আগ্রহ থেকে আমার সাথে যোগ দিয়েছিলেন সহকর্মী বিজ্ঞ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ জিল্লুর রহমান, ওসি হুমায়ুন কবির এবং উপজেলা বন কর্মকর্তা মোঃ শরিফুল।

স্ট্যাস্টার্স থেকে জানা যায়, শুরু থেকেই কত সমস্যা! লাশ বহনের খাটিয়া দিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনীহা। কিন্তু আমি যাওয়াতে তো আর না করার উপায় নেই! অতএব ব্যবস্থা হলো। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্যদের আন্তরিকতার কোন অভাব ছিলনা। কিন্তু চারজনে খাটিয়াসহ লাশ বইতে পারছিলেন না। আরেকটু সহযোগিতার দরকার ছিল। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের একজন যিনি পিঠে জীবাণুনাশক স্প্রে মেশিন এবং হাতে টর্চ লাইট বহন করছিলেন তিনি সহযোগিতা করতে চাইলেন। কিন্তু তার পিপিই নেই। অতএব তাকে অনুমতি দিতে পারছিলাম না!

মৃতের ভাই বিকেল থেকেই পিপিই পরে ঘুরছিলেন। তাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খাটিয়া বইতে সহায়তা করার অনুরোধ করলাম। বলামাত্র সেখান থেকে এক প্রকার দৌঁড়ে চলে গেলেন! আর এলেন না। চারপাশে কোন আত্নীয় স্বজন নেই। অন্ধকারে ভুতুরে পরিবেশ! মৃত ব্যক্তির দুটো সন্তান কেঁদেই চলেছে। ওরা কাছেও আসতে পারছেনা। ছটফট করছে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের চারজনে তখনও লাশের খাটিয়া উঠানোর চেষ্টা করছে। উঠানোর পর এগুতে পারছেনা। আবার নামিয়ে ফেলছে। বেশ ভারী।

সদ্য প্রয়াত প্রিয় পিতার এমন অসহায় অবস্থা কোন সন্তান মেনে নিতে পারেনা। বড় সন্তান নাসিম যে এবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছে সে কাতর কন্ঠে অনুরোধ করতে লাগলো সে খাটিয়া ধরতে সাহায্য করবে কিনা? কষ্ট হলেও তাকে ‘না’ বললাম।

আরেকটা পিপিইর ব্যবস্থা হলো। সেটা পরানো হলো কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সে সদস্যকে যিনি টর্চলাইট এবং জীবানুনাশক স্প্রে বহন করছিলেন। তারা মিলে খাটিয়া উঠালেন। এবার টর্চ জ্বেলে সামনে পথ দেখানোর জন্য একজনকে খুঁজছিলাম। ডাকাডাকি করলাম। অনুরোধ করলাম। আত্নীয়স্বজন কেউ এলোনা! নিরাপদ দূরত্বে থেকে শুধু একটা টর্চের আলো ফেলে পথ দেখাবে এর জন্যও কোন স্বজন রাজী হয়না!

যেহেতু জানাজা শেষ তাই ইমাম সাহেব চলে যেতে চাচ্ছিলেন। তাকেই বিনীতভাবে অনুরোধ করলাম টর্চ জ্বেলে পথ দেখিয়ে লাশবহনকারীদের সহায়তা করার জন্য। তিনি অনুরোধ রাখলেন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্য আর ইমাম সাহেবের আন্তরিক সহযোগিতায় অবশেষে দাফন সম্পন্ন হলো।

দাফন কার্যক্রমে আত্নীয়-স্বজনদের এমন আচরণ দেখে মৃতের স্ত্রী আর সন্তানদুটো কতটা কষ্ট পেয়েছে অনুমান করতে আমার বুক কাঁপছে! ওরা ভাইবোন একে অন্যকে জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিল! নাসিম চিৎকার করে লাশবহনকারীদের বলছিল ‘ভাই ভারী মনে হলে একটু নামিয়ে নিয়েন, তবু আব্বু যেন পরে না যায়!’

আমি, আমার সহকর্মী জিল্লুর, ওসি সাহেব আর উপজেলা বন কর্মকর্তা পুরো দৃশ্য দেখে কেমন বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম! করোনা যে কত কি শিখাবে কে জানে?ফেরার পথে যখন দেখি রাত সাড়ে৯ টা সদরের হিন্দু পাড়ার মোড়ে চার জনে ব্যপক ক্যারাম খেলছে... মেজাসটা আর ঠিক রাখতে পারলাম না! এই আমাদের করোনার ভয়? করোনাকে কোন ভয় নেই, কোন নিয়ম কেউ মানবেনা... আবার করোনায় মারা গেলে তার প্রতি এত অবহেলা? চারজনকেই পুলিশের জিপে তুলে দিলাম। সাথে প্রিয় ক্যারামখানাও! অভিভাবকরা ঘরে বসে প্রিয় সন্তানের খোঁজ রাখতে পারেনি এখন থানায় এসে খোঁজ নিক!

রাত ২টা পেরিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন এখনও কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আজ থেকে প্রায় চারবছর আগে আমিও বাবার জন্য এভাবে কেঁদেছিলাম। তবে পার্থক্যটা হলো আমি আমার বাবাকে শেষ বারের মতো জরিয়ে ধরে কাঁদতে পেরেছিলাম.... কিন্তু ভাগ্যহত নাসিম আর তার ছোট বোন তা পারেনি! শফিউর সাহেবের বিদেহী আত্মা জান্নাতবাসী হোক। আল্লাহ শোকসন্তপ্ত পরিবারকে এ শোক সইবার শক্তি দিক। আমিন।#




সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

জীবন যাত্রা বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই