তারিখ : ১৭ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

বাজেট প্রস্তাবনা ২০১৯-২০

তরুণ,নারী এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠির সুরক্ষায় তামাকপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি
বাজেট প্রস্তাবনা ২০১৯-২০
[ভালুকা ডট কম : ২৮ এপ্রিল]
বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ (এঅঞঝ, ২০১৭ ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ২০.৬ শতাংশ (২ কোটি ২০ লক্ষ) এবং ধূমপায়ী ১৮ শতাংশ (১ কোটি ৯২ লক্ষ)। তামাক ব্যবহারকারী অতি উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠির (২৪%) তুলনায় অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে তামাক ব্যবহারের উচ্চ প্রবণতা (৪৮%) এবং বিশেষত পুরুষের (১৬%) তুলনায় নারীদের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের উচ্চহার (২৪.৮%) যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এছাড়া শহরের জনগোষ্ঠির (২৯.৯%) তুলনায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠির (৩৭.১%) মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার অনেক বেশি। বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে তামাক আসক্তি অত্যন্ত উদ্বেগজনক; ১৩-১৫ বছর বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯.২ শতাংশ (GSHS, ২০১৪)।  তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজার মানুষ অকাল মৃত্যু বরণ করে।

সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা , যা একই সময়ে (২০১৭-১৮) তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের (২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা) চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশের বর্তমান তামাক কর-কাঠামো অত্যন্ত জটিল এবং তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণে যথেষ্ট নয়। বিদ্যমান তামাক কর পদক্ষেপ বা কাঠামো বিশ্লেষণ করলে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে-

এক, বাংলাদেশে তামাকের ওপর বিদ্যমান কর-কাঠামো অত্যন্ত জটিল, পুরোনো ও অকার্যকর। সিগারেটের উপর করারোপের ক্ষেত্রে বর্তমানে বহুস্তরবিশিষ্ট এডভ্যালোরেম (মূল্যের শতকরা হার) প্রথা কার্যকর রয়েছে, যা বিশ্বের মাত্র ৫/৬টি দেশে চালু আছে। উপরন্তু, তামাকপণ্যের ধরন (সিগারেট, বিড়ি, জর্দা ও গুল); তামাকপণ্যের বৈশিষ্ট্য (ফিল্টার-ননফিল্টার বিড়ি); জর্দা ও গুলের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ‘ট্যারিফ ভ্যালু’ এবং সিগারেটের ব্রান্ড (৪টি মূল্যস্তর) ভেদে ভিত্তিমূল্য ও কর-হার এ ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। একাধিক মূল্যস্তর এবং বিভিন্ন দামে তামাকপণ্য ক্রয়ের সুযোগ থাকায় তামাকের ব্যবহার হ্রাসে কর ও মূল্যপদক্ষেপ সঠিকভাবে কাজ করেনা। করপদক্ষেপের কারণে একটি মূল্যস্তরে তামাকপণ্যের দাম বাড়লে অথবা ভোক্তার জীবনমানে কোন পরিবর্তন ঘটলে সে তার পছন্দ (choice) সুবিধামতো স্তরে স্থানান্তর (switch) করতে পারে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে তার রুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী অন্য মূল্যস্তরের তামাক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। এর পাশাপাশি তামাক কোম্পানিগুলোও উচ্চস্তরের সিগারেট নিন্মস্তরে ঘোষণা দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পায়।

দুই, বাজেটে করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি জনগণের বাৎসরিক মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ সালের তুলনায় ২০১৭-১৮ সালে মাথাপিছু জাতীয় আয় (নমিন্যাল) বেড়েছে ২৫.৪ শতাংশ। অথচ এসময়ে বেশিরভাগ তামাকপণ্যের দাম হয় অপরিবর্তিত থেকেছে অথবা সামান্য পরিমাণে বেড়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান ধারা চলতি অর্থবছরেও অব্যাহত থাকবে বলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছেন।

তিন, আইন বহির্ভূত বা অনিয়ন্ত্রিত উপায়ে সস্তা তামাকপণ্য বিশেষ করে গুল, জর্দা, সাদাপাতা এবং বিড়ি উৎপাদন ও বিপণনের সুযোগ। বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের উৎপাদন ও বিপণন চলে অনেকটা অনিয়ন্ত্রিতভাবেই। ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য উৎপাদনে ভারি/দামি যন্ত্রপাতি এবং পুঁজির তেমন দরকার হয়না বলে গৃহস্থালি পর্যায়েও এগুলোর উৎপাদন হয়ে থাকে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এনবিআরের মূসক নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা সংক্রান্ত টাস্কফোর্স সারাদেশে ৩২টি ব্র্যান্ডের গুল ও ৪২১টি ব্র্যান্ডের জর্দা কোম্পানির একটি তালিকা তৈরি করলেও এর পূর্ণাঙ্গ কোন পরিসংখ্যান এখনও নেই। এদের বেশিরভাগই সরকারের করজালের বাইরে রয়ে গেছে। অর্থাৎ তামাক নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে প্রমাণিত তামাককর পদক্ষেপ বাংলাদেশে বেশিরভাগ তামাক ব্যবহারকারী, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী নারী এবং দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষা প্রদান করতে পারছেনা। সরকারও বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে।

চার, জাতীয় স্বার্থের বিপরীতে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিকে বাড়তি সুবিধা প্রদান। যেমন, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, করারোপের ফলে নিন্মস্তরের সিগারেটের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও অতি উচ্চস্তরের (দশ শলাকা ১০৫ টাকা) সিগারেটের দাম বিগত দুই বছর অপরিবর্তীত রাখার পর মাত্র ৪ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। অথচ এসময়ে মাথাপিছু জাতীয় আয় (নমিন্যাল) বেড়েছে ২৫.৪ শতাংশ। অর্থাৎ এই স্তরের সিগারেটের প্রকৃত মূল্য ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, পাশাপাশি সরকারও বাড়তি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

উল্লেখ্য, বর্তমানে এই অতি উচ্চস্তরের সিগারেটের বাজার পুরোটাই রয়েছে বহুজাতিক তামাক কোম্পানির দখলে এবং  সরকারের সিগারেট রাজস্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশ আসে এই স্তর থেকে। এছাড়াও, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদিত নিন্ম মূল্যস্তরের সিগারেটের মূল্য এবং সম্পূরক শুল্ক বিশেষভাবে বৃদ্ধি করা হলেও বহুজাতিক তামাক কোম্পানি বিএটিবি সরকারের এই নির্দেশনা মানেনি। উপরন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) বাজেট এসআরও এর সাথে  ০৭ জুন ২০১৮ তারিখে এক বিশেষ আদেশ দ্বারা বিএটিবির এই অর্থ মওকুফের সুযোগ করে দেয়। এরফলে সরকার ২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয় (নিউ এইজ, ১০ জুন ২০১৮)।

পাঁচ, বাংলাদেশে নেই কোনো তামাক-কর নীতিমালা: উপেক্ষিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা। তামাকখাত থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণের কোন সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। আশার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল অর্থাৎ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন এবং এই লক্ষ্য অর্জনে তামাকের উপর বর্তমান শুল্ক-কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্ক-নীতি গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেছেন যাতে জনগণের তামাকজাত পণ্যের ক্রয়-ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং একইসাথে সরকারের শুল্ক আয় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ইতিমধ্যে ৩ বছর পেরিয়ে গেলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উক্ত নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তামাকপণ্যে কার্যকরভাবে করারোপ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত: তামাকপণ্য দিন দিন সস্তা থেকে আরও সস্তা হচ্ছে (চিত্র ১), ফলে এর ব্যবহার ও ব্যবহারজনিত ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পাচ্ছে যা রোধ করা জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের তথ্যমতে, পৃথিবীতে যেসব দেশে সিগারেটের মূল্য অত্যন্ত কম বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। এক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমার, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার পরেই বাংলাদেশে কম দামে সস্তা ব্রান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য আরও সস্তা। প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) কর্তৃক রিলেটিভ ইনকাম প্রাইস (আরআইপি) পদ্ধতির মাধ্যমে সিগারেটের স্তরভিত্তিক সহজলভ্যতা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ সালে একজন ধূমপায়ীর প্রিমিয়াম, উচ্চ এবং মধ্যমস্তরে ১০০০ শলাকা সিগারেট কিনতে যেখানে মাথাপিছু জিডিপি’র যথাক্রমে ৯.৩২, ৬.৪৬ ও ৪.১৫ শতাংশ ব্যয় হতো, সেখানে ২০১৭-১৮ সালে একই পরিমাণ সিগারেট কিনতে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে ৭.৩৪, ৫.০৯ ও ৩.২৭ শতাংশ। নিন্মস্তরে এই হার প্রায় একই রয়েছে। গ্যাটস ২০১৭ অনুযায়ী, ২০০৯ এর তুলনায় ২০১৭ সালে সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ সিগারেটের প্রকৃত মূল্য ক্রমশ হ্রাস পাওয়ায় সিগারেটের ব্যবহার কমছেনা।

দ্বিতীয়ত: তামাক কর স্বল্পমেয়াদে অভ্যন্তরীণ অর্থায়নের একটি অন্যতম উৎস। জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবাতে অনুষ্ঠিত ‘উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন’ শীর্ষক বিশ্ব সম্মেলনে তামাক করকে রাজস্ব আহরণের একটি কার্যকর ও সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

বাংলাদেশে বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন। বাস্তবতা হলো মোট তামাক রাজস্বের মাত্র ০.২ শতাংশ (২০১৭-১৮ অর্থবছর) আসে ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে। সুতরাং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য থেকে সরকারের বাড়তি রাজস্ব আয়ের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।

তৃতীয়ত: গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকের উপর কার্যকরভাবে করারোপ করলে তামাকের ব্যবহার হ্রাস পায় এবং রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পায়। ফিলিপাইন, তুরস্ক, মেক্সিকো ও সাউথ আফ্রিকা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সাউথ আফ্রিকায় ১৯৯৩ থেকে ২০০৯ সময়কালে সিগারেটের প্রকৃতমূল্য ৩২ শতাংশ থেকে ৫২ শতাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে ফলে সেখানে একদিকে প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠির মাঝে মাথাপিছু দিনপ্রতি সিগারেট সেবনের পরিমাণ ৪টি থেকে কমে ২টিতে নেমে এসেছে অন্যদিকে এসময়ে সরকারের রাজস্ব আয় ৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশে তামাকপণ্যে যে সম্পূরক শুল্ক বিদ্যমান রয়েছে তা আরোপ করা হয় ad valorem অর্থাৎ মূল্যের শতাংশ হারে। বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশ তামাকপণ্যে কার্যকর করারোপে মিশ্র পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে ad valorem পদ্ধতির পাশাপাশি সম্পূরক শুল্কের একটি অংশ সুনির্দিষ্ট (specific) আকারে আরোপ করা হয়। সুনির্দিষ্ট কর শলাকার সংখ্যা (বিড়ি, সিগারেট) বা ওজনের (গুল, জর্দা) উপর ধার্য হয়। সুতরাং সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক প্রচলনের প্রস্তাব বিদ্যমান জটিল কর ব্যবস্থা সহজীকরণ এবং তামাক কোম্পানির অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ রহিতকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বাংলাদেশে তামাকের ভয়াবহতা মোকাবেলা ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে তামাকজাত পণ্যে কার্যকর ও বর্ধিত হারে করারোপের দাবিতে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও সুপারিশ সমূহ নিচে তুলে ধরা হলো:

বাজেট প্রস্তাব
১.সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা ৪টি থেকে কমিয়ে ২টিতে (নিন্ম এবং উচ্চ) নিয়ে আসা:
৩৫ টাকা এবং ৪৮ টাকা এই দুইটি মূল্যস্তরকে একত্রিত করে একটি মূল্যস্তর (নিন্মস্তর) এবং ৭৫ টাকা ও ১০৫ টাকা মূল্যস্তরকে একত্রিত করে আরেকটি মূল্যস্তরে (উচ্চস্তর) নিয়ে আসা; নিন্মস্তরে ১০ শলাকা সিগারটের খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা এবং উচ্চস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ন্যূনতম ১০৫ টাকা নির্ধারণ করে ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; এবং সকল ক্ষেত্রে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটে ৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
২.বিড়ির ফিল্টার এবং নন-ফিল্টার মূল্য বিভাজন তুলে দেওয়া:
বিড়ির মূল্য বিভাজন তুলে দিয়ে ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৩৫ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক ও ৬ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২৮ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক এবং ৪.৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
৩.ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের (জর্দা ও গুল) ট্যারিফ ভ্যালু প্রথা বিলুপ্তকরণ:
ট্যারিফ ভ্যালু প্রথা বিলুপ্ত করে সিগারেট ও বিড়ির ন্যায় ‘খুচরা মূল্যের’ ভিত্তিতে করারোপ করা; প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৩৫ টাকা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; এবং প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার উপর ৫ টাকা ও প্রতি ১০ গ্রাম গুলের উপর ৩ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
৪.সকল তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বহাল রাখা।

সুপারিশমালা
১.তামাকপণ্যের সহজলভ্যতা হ্রাস করতে মূল্যস্ফীতি এবং আয় বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি করতে হবে;
২.বিভিন্ন তামাকপণ্য ও ব্রান্ডের মধ্যে সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য ব্যবধান কমিয়ে আনার মাধ্যমে তামাক ব্যবহারকারীর ব্রান্ড ও তামাকপণ্য পরিবর্তনের সুযোগ সীমিত করতে হবে;
৩.সকল ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য উৎপাদনকারীকে সরকারের করজালের আওতায় নিয়ে আসতে হবে;
৪.পর্যায়ক্রমে সকল তামাকপণ্য অভিন্ন পরিমাণে (শলাকা সংখ্যা এবং ওজন) প্রমিত প্যাকেট/কৌটায় বাজারজাত করা;
৫.একটি সহজ এবং কার্যকর তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন (৫ বছর মেয়াদি) করা, যা তামাকের ব্যবহার হ্রাস এবং রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে;
৬.সকল প্রকার ই-সিগারেট এবং হিটেড (আইকিউওএস) তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি এবং বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা;
৭.কঠোর লাইসেন্সিং এবং ট্রেসিং ব্যবস্থাসহ তামাক কর প্রশাসন শক্তিশালী করা, কর ফাঁকির জন্য শাস্তিমূলক জরিমানার ব্যবস্থা করা;
৮.স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বৃদ্ধি (২%) করা।

উল্লিখিত ‘তামাক-কর’ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে সিগারেটের ব্যবহার ১৪% থেকে হ্রাস পেয়ে প্রায় ১২.৫% ও বিড়ির ব্যবহার ৫% থেকে হ্রাস পেয়ে ৩.৪% হবে এবং অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে ৬ হাজার ৬৮০ কোটি থেকে ১১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার মধ্যে (জিডিপি’র ০.৪ শতাংশ পর্যন্ত)। এই অতিরিক্ত রাজস্ব তামাক ব্যবহারের ক্ষতি হ্রাস, অকালমৃত্যু রোধ এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে ব্যয় করা সম্ভব হবে। সম্প্রতি, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, আগামী অর্থবছর থেকেই ‘মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২’ কার্যকর হবে এবং মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলেছেন ভ্যাটের হার হবে ৫, ৭ ও ১০ শতাংশ। পাশাপাশি করপোরেট করহার কমানোর ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি। অর্থমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়, তবে তামাকের মত স্বাস্থ্য হানিকর পণ্যের (Sin Products) ক্ষেত্রে একই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে তামাকপণ্যের দাম কমবে, এর ব্যবহার বাড়বে এবং একইসাথে তামাক ব্যবসা উৎসাহিত হবে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

তামাক কোম্পানিগুলো তরুণ এবং শিশুদের টার্গেট করে ইমার্জিং তামাকপণ্য হিসেবে ইলেক্ট্রনিক সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড (আইকিউওএস) টোব্যাকো প্রোডাক্ট ইত্যাদিকে প্রথাগত সিগারেটের ‘নিরাপদ বিকল্প’ হিসেবে উপস্থাপন করা শুরু করেছে। উদ্ভাবনী কৌশল এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর এবং তরুণদের মাঝে বিশেষত বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে এসব তামাকপণ্য জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করেছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশে এসব পণ্য ব্যবহার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তবে বাংলাদেশে এখনো তা প্রকট আকার ধারণ করেনি। ইতোমধ্যে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ কমপক্ষে ২৫টি দেশ এসব পণ্য নিষিদ্ধ করেছে। সুতরাং বাংলাদেশে এখনই এগুলোর উৎপাদন, আমদানি এবং বিক্রয় নিষিদ্ধ করতে হবে।

বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠির প্রায় অর্ধেক নারী এবং ৩০ শতাংশ তরুণ। তামাক কোম্পানি বিশেষ করে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলোর মূল টার্গেট এখন বাংলাদেশ। পৃথিবীর ৪র্থ বৃহত্তম তামাক কোম্পানি জাপান টোব্যাকোকে ব্যবসার সুযোগ দিয়ে সরকার ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যকে আরেক দফা হুমকির মুখে ফেলেছে। এভাবে তামাকের ব্যবহার এবং তামাক কোম্পানিকে ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ প্রদান অব্যাহত থাকলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগজনিত মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না। সুতরাং প্রস্তাবিত তামাক-কর সংস্কারের ফলে তরুণ, নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে তামাক ব্যবহারের প্রবণতা হ্রাস পাবে। একইসাথে, তামাকপণ্যের সহজলভ্যতা হ্রাস পাবে এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে।#



সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

অন্যান্য বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই