তারিখ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

খরস্রােতা আত্রাই ও ছোট যমুনা নদী এখন মরা খাল

এক সময়ের খরস্রােতা আত্রাই ও ছোট যমুনা নদী এখন মরা খাল
[ভালুকা ডট কম : ২৩ এপ্রিল]
নওগাঁ জেলার মধ্যদিয়ে ছোট-বড় মোট ৭টি নদী বয়ে গেছে। এরমধ্যে এক সময়ের দুটি প্রধান খরস্রােতা নদী হচ্ছে আত্রাই ও ছোট যমুনা নদী। শুষ্ক মৌসুমে ভারতের অভ্যন্তরে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় অস্তিত্ব হারাতে বসেছে এক সময়ের খরস্রোতা আত্রাই নদী। উত্তাল নদীটি এখন শুধু নামেই। তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পরিণত হয়েছে মরা খালে।

ভারতের হিমালয়ের পাদদেশ থেকে উৎপত্তি আত্রাই নদীর। এরপর ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর হয়ে নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই নদীটি জেলার ধামইরহাট, পত্নীতলা, মহাদেবপুর, মান্দা, আত্রাই ও রাণীনগর উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত। প্রত্যেক খরা মৌসুমে ভারতের অভ্যন্তরে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন শেষে বাঁধ কেটে দিলে নদীর পানি প্রবাহ আবারও স্বাভাবিক হয়ে যায়। বারবার বাঁধ দেয়া কারণেই ক্রমান্বয়ে নদীর তলদেশ ভরাট যাচ্ছে। এ কারণে প্রতিবছর খরা মৌসুমে শুকিয়ে যাচ্ছে নদীটি।

অপরদিকে ছোট যমুনা নদী দিনাজপুর জেলার ইছামতি নদী পার্বতীপুর উপজেলার মোমিনপুর ইউনিয়নে ছোট যমুনা নদী নাম ধারন করেছে। এই নদীটি জেলার ধামইরহাট,বদলগাছী, নওগাঁ সদর, রাণীনগর ও আত্রাই উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত। শুষ্ক মৌসুমে ভারত থেকে পানি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বর্তমানে এই নদীটিও মরা খালে পরিণত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া অধিকাংশ নদীর উৎসই হচ্ছে ভারত। এই নদীগুলোর উৎসের অববাহিকায় বৃষ্টিপাত কম হওয়া, ভারতের অভ্যন্তরে সাময়িক বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার, পলি জমে তলদেশ ভরাট, ইরিগেশনের সময় ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারসহ জলবায়ুর পরিবর্তন নদীটির অস্তিত্ব সংকটের প্রধান কারণ। তারা আরও বলেন, জরুরি ভিত্তিতে তলদেশ ড্রেজিং, রাবার ড্রাম তৈরি করে পানি সংরক্ষণ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে দিলে অন্যান্য নদ-নদীর মত মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে না নদীগুলো।

আত্রাই নদীর তীরবর্তি বাসিন্দা প্রবীন ব্যক্তি তনজেব আলী বলেন, খুব বেশি আগের কথা নয়। আশির দশক জুড়েই নদীটির ভরা যৌবন ছিল। সে সময় আত্রাইয়ে তর্জন-গর্জনে মানুষের বুকে কাঁপন সৃষ্টি হতো। নব্বইয়ের দশক থেকে ক্রমেই যৌবন হারাতে বসে নদীটি। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে নদীটির আর হারানোর কিছুই নেই। সরু মরা খালে পরিণত হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভরা যৌবনে আত্রাই নদীর ঢেউয়ের তালে চলাচল করত পাল তোলা অসংখ্য নৌকা। ভাটিয়ালি আর পল্লীগীতি গানের সুরে মাঝিরা নৌকা নিয়ে ছুটে চলতেন জেলার আত্রাই, রাণীনগর, মান্দা, মহাদেবপুর, ধামইরহাট, পত্মীতলাসহ অন্যান্য জেলা ও উপজেলার নদী কেন্দ্রিক ব্যবসা কেন্দ্রগুলোতে। এ নদীকে ঘিরে বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে বড়বড় হাটবাজার। ওই সময় আত্রাই নদীর ছিল পূর্ণ যৌবন। এ নদীকে অবলম্বন করে অসংখ্য মানুষ ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবন জীবীকার সহজপথ খুঁজে পেয়েছিলেন।

সচেতনমহল বলছেন দখল আর দুষণে নদীটির অস্তিত্ব বিলিন হতে চলেছে। সরকারের নজর না থাকার সুযোগে এক শ্রেণির দখলবাজ নদীটির অনেক স্থান দখলে নিয়ে ভরাট করে দিচ্ছে। একই সঙ্গে চলছে অপরিকল্পিত ভাবে যত্রতত্র বালু উত্তোলন ও পাড় কেটে মাটি বিক্রির প্রতিযোগিতা। এতে হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে নদীটির অস্তিত্ব। অচিরেই ব্যবস্থা নেওয়া না হলে মানচিত্র থেকে মুছে যাবে এক সময়ের খরস্রোতা এই নদীগুলোর নাম। হুমকির মুখে পড়বে এলাকার জীববৈচিত্র। শুধু হাটবাজারই নয়, এ নদী কেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে অনেক জনপদ। নদীর অথৈ পানি দিয়ে কৃষকরা দুইপাড়ের উর্বর জমিতে ফসল ফলান। প্রকৃতির অফুরন্ত পানিতে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার জুড়ে সবুজের সমারোহে ভরে উঠে আত্রাই নদীর দুই ধারের জমি।

জীবীকার সন্ধানে নদী সংলগ্ন ও আশপাশের এলাকায় অসংখ্য জেলে পরিবারের বসতি গড়ে উঠেছিল। ছোট-বড় নানা প্রজাতির মাছের অফুরন্ত উৎস ছিল এই নদী। মাছ পাওয়া যেত বছর জুড়ে। জীবিকার তাগিদে জেলেরা রাতদিন ডিঙি নৌকায় জাল দড়ি নিয়ে চষে বেড়াতেন নদীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। ধরা পড়তো প্রচুর মাছ। সেই সোনালী দিন শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। কালের বিবর্তনে সেই নদীগুলো এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। সেচ সংকটে পড়ছে কৃষি জমিগুলো। জেলে পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে দুর্দিন। এক সময়ের ব্যবসা বাণিজ্যের উৎসগুলো হয়ে গেছে বন্ধ। এ সবই এখন কালের সাক্ষি।

নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী প্রবীর কুমার পাল বলেন জেলার প্রধান নদী দুটি পলি পড়ে তার নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। এই হাইড্রো-মরফোলজিক্যাল পরিবর্তনের কারণে নদীগুলো ক্রমাগত তার গতিপথ পরিবর্তন করছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য নদী খনন করা আবশ্যক। এই নদী খননের ফলে নদীর পানি ধারন ক্ষমতাও বাড়বে, কৃষকগণ নদীর পানি ব্যবহার করে সেচ কার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন। তাছাড়াও ছোট যমুনা নদীটি খনন করা হলে বর্ষাকালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ টপকিয়ে লোকালয়সহ ফসলের যে ক্ষতি হয় তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। ছোট যমুনা নদীটি খননের জন্য জেলার একাধিক আসনের সাংসদগণ মাননীয় পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মহোদয় বরাবর ডিও লেটার প্রদান করেছেন। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশে “৬৪টি জেলার ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের” ২য় পর্যায়ে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে ছোট যমুনা নদী পুনঃখননের ফলে আবার নদীটি প্রাণবন্ত হবে। তিনি আরো বলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়, সিনিয়র সচিব মহোদয় এবং প্রকৌশলী মহোদয়গণের সঠিক নির্দেশনায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬৪টি জেলার ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমস্ত নদীকে পুনঃরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নদীর গভীরতা বৃদ্ধি, রাবার ড্রাম তৈরি করে পানি সংরক্ষণসহ নিচের পানির কম ব্যবহার করলে এটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবেও মন্তব্য করেন তিনি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের পরিচালক ডা. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ভূ-গর্ভস্থ পানির সঙ্গে নদীর স্তরের একটা সংযোগ রয়েছে। কোন কোন সময় ভূ-গর্ভস্থ পানি নদীতে আবার নদী থেকে পানি ভূ-গর্ভস্থ স্তরে রিচার্জ হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তন ও অনাবৃষ্টির কারণে প্রকৃতির এসব স্বাভাবিক কাজে বিঘ্ন ঘটছে। এছাড়া নদীর উৎসের অববাহিকায় বৃষ্টিপাত কম ও ভারতের অভ্যন্তরে সময়ে অসময়ে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আজ আত্রাই নদীর এ অবস্থা। নদীটির অস্তিত্ব হারিয়ে গেলে জীবন-জীবিকার ওপর বিরুপ প্রভাব পড়বে। তিনি আরও বলেন, নদীর গতিপথ ঠিক রাখতে যত্রতত্র বালু উত্তোলন বন্ধসহ বিশ্ব নদী আইন মেনে পানির সুষম বন্টন হলেই শুধু এই দুটি প্রধান নদীসহ অন্যান্য নদীগুলোরও অস্তিত্ব বিলিন হবে না।#



সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই