তারিখ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

হোটেলে কাজ করা সেই ইউপি সদস্য হাসপাতালে

হোটেলে কাজ করা সেই ইউপি সদস্য দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে
[ভালুকা ডট কম : ১৭ জুন]
হোটেলে কাজ করে সংসার চালানো সেই ইউপি সদস্য খোদেজা খাতুন এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। খোদেজার ছেলে হাফেজ খিজির জানান, গত রোববার হোটেলের কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে মা খোদেজা উপজেলার আসানবাড়ি এলাকায় একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যান থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন। স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয়। তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছেন। এছাড়া বাম হাতের কবজিসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত পেয়েছেন। তিনি জানান, চিকিৎসা খরচ নেই। ইউপি চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন হিতৈষী ব্যক্তি হাসপাতালে দেখতে গিয়ে যা সহায়তা করছেন তা দিয়েই চিকিৎসা চলছে।

খোদেজা খাতুন সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপেজলার বারুহাস ইউনিয়নের ৩ নম্বর সংরক্ষিত আসনের (৭,৮ও ৯নং ওয়ার্ড) দ্বিতীয়বার নির্বাচিত ইউপি সদস্য। একজন জনপ্রতিনিধি হয়েও তিনি হোটেলে বুয়ার কাজ করে সংসার চালান। তার স্বামী আবু তাহের একজন পান দোকানদার। স্বামীর নামে একটি ভিজিডি কার্ড ছিল। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবার পর সেই কার্ডটি অন্যকে দিয়ে দিয়েছেন। তার সততায় মুগ্ধ ইউনিয়নবাসী। এলাকার মানুষের কাছে তিনি সততার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তিনি বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। চিকিৎসার অর্থ নেই। ইউপি চেয়ারম্যানসহ কতিপয় হিতৈষী ব্যক্তির সহায়তায় চলছে তার চিকিৎসা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাড়াশ উপজেলার বিনসাড়া গ্রামের তার পৈত্রিকবাড়ী। বাবার নাম কেতাব আলী। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী খোদেজা খাতুনের জন্ম ১৯৫২ সালের ২০ নভেম্বর। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় খোদেজা ছোটবেলায় গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা শুরু করলেও তা আর এগোয়নি। অভাবের সংসারে কাজ করতেন অন্যের বাড়িতে। এক সময় রাস্তায় মাটি কাটার কাজও করেন। স্বাধীনতার ৩ বছর পর পাশ্ববর্তী খুটিগাছা গ্রামে আবু তাহেরের সঙ্গে বিয়ে হয়। অভাবের সংসারে স্বামীর সামান্য জমিজমা থাকায় সেটুকু দুজনে মিলে চাষাবাদ শুরু করেন। এরই মধ্যে তাদের পরপর তিন সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানের ভরনপোষন দুঃসাধ্য হয়ে পড়ায় জমিজমা বিক্রি করে দিয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ী বিনসাড়া এলাকায় চলে আসেন। সেখানে বাজারের পশ্চিমপাশে মনিপুকুরপাড়ে সরকারি খাসজমিতে এককক্ষের একটি টিনের ঘর তোলেন। স্বামী আবু তাহের বিনসাড়া বাজারে একটি পানের দোকান শুরু করেন। অভাবের সংসারে হাল ধরতে খোদেজা বেগম শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। বিভিন্নজনের জমিতে কাজ করে যা পেতেন তাই দিয়ে সংসার চালাতেন। তিন সন্তান বড় হবার পর বিয়ে সাদি করে প্রায় ২০ বছর আগে সবাই আলাদা হয়ে যায়। সততার সাথে এবং মানুষের বিপদে-আপদে অর্থ দিয়ে না হলেও সহানুভুতির সাথে পাশে থাকায়  মানুষের কাছে প্রিয় মানুষ হয়ে ওঠেন। কখনো শ্রমিক আবার কখন হোটেলের বুয়া কাজ করাবস্থায় এলাকাবাসীর অনুরোধে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন করেন। প্রথমবার ফেল করেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে নির্বাচনে তিনি ইউপি সদ্যসা নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হলেও তার কোন আর্থিক মোহ ছিল না। যখন ইউনিয়ন পরিষদে কাজ থাকত তখন ইউনিয়ন পরিষদে যেতেন। বর্তমানে খোদেজার বয়স প্রায় ৭০। বয়স হলেও জনপ্রতিনিধি ও সংসারের দায়িত্ব তাকে কাবু করতে পারেনি। এ বয়সেও তিনি সকালে ঘুম থেকে ওঠে প্রায় সাত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে তাড়াশ বাজারের এশটি হোটেলে থালা বাসন মাজার কাজ করতে যান। হোটেলে কাজ করে পান ১৫০। বর্তমানে তাদের বসবাসের ঘরটিও নড়বড়ে। টিনের চালা ঘরের চালে ফুটো, বেড়াগুলো নস্ট ও মাটির মেঝের ঘরটিতে গরম-শীত সব ঋতুতেই কষ্ট হয় বয়স্ক এ দম্পতির। নেই স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের ব্যবস্থা। ইউপি সদস্যা খোদেজা বেগম জানান, আমার এলাকার লোকজন আমাকে ভালবেসে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। তারা যখন যে কাজে ডাক দেয় আমি ছুটে যাই। সরকারি যত সুবিধা পাই, তা গরীব মানুষের মধ্যে বন্টন করে দেই। আর নিজের সংসার চালানোর জন্য হোটেলে কাজ করি। প্রতিদিন দুবেলা খাবার ও ১৫০ টাকা করে পেয়ে থাকি। তিনি জানান, যখন পরিষদে কাজের ডাক পড়ে তখন ছুটি নিয়ে সেখানে চলে যাই। হাসপাতাল বেডে শুয়ে থেকে তিনি জানান, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যেন মানুষ ভালবেসে যে দায়িত্ব দিয়েছে তা সততার সাথে পালন করতে পারি।

পান দোকানদার স্বামী আবু তাহের বলেন, আমাদের কোন লোভ-লালসা নাই। সরকারী জায়গায় থাকি। ঘরটিও ভাঙ্গা। বহুকস্টে থাকলেও মনের দিক থেকে দুজনে সুখে-শান্তিতে আছি। আমার নামে একটি ইউনিয়ন পরিষদের কার্ড ছিল। তাও অন্যেকে দিয়ে দিয়েছি। অর্থ সম্পদ দিয়ে কি হবে? সততার সাথে কোন রকম ডাল-ভাত খেয়ে মানুষের সেবা করাই আমাদের উদ্দেশ্যে।

তাড়াশ বাজারের হোটেলে সাহা অ্যান্ড সন্সের ব্যবস্থাপক আবদুর রশিদ জানান, প্রতিদিন সকালে সাত কিলোমিটার দুর থেকে তিনি হোটেলে আসেন। সারাদিন কোটা-বাছা, বাসন ধোয়া-মোছা কাজ করেন। তবে ইউনিয়ন পরিষদে কাজ থাকলে তিনি আগে থেকে ছুটি নিয়ে রাখেন।

স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ভিলেজ ভিশনের পরিচালক শরিফ খন্দকার জানান, দেশে যেখানে প্রায় সব জনপ্রতিনিধি নিজের পদকে ক্ষমতা ও অর্থ বানানোর হাতিয়ার মনে করেন, সেখানে খোদেজা খাতুন হোটেলে কাজ করে সংসার চালান, এটা কল্পনাও করা যায় না। তার মত জনপ্রতিনিধি দেশে থাকলে দেশ আরো এগিয়ে যেতো। তিনি খোদেজা যেন সৎভাবে বেঁচে থেকে মানুষের সেবা করতে পারেন সে জন্য তার পাশে সবার দাঁড়ানো উচিত বলে মনে করেন।

ইউপি চেয়ারম্যান ময়নুল হক জানান, দীর্ঘদিন যাবত জনপ্রতিনিধিত্ব করছেন খোদেজা খাতুন। সরকারী জায়গায় একটি ঘরে থাকেন। জরুরী মিটিংগুলোতে তিনি পরিষদে উপস্থিত থাকেন। ঘর না থাকার বিষয়টি জানার পরই আমি ইউএনও মহোদয়কে ঘর নির্মাণের কথা বলেছি। তিনি আশ্বস্ত করেছেন। তিনি জানান, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেছি। ইউএনও মহোদয় হাসপাতালে ছুটে গিয়ে সহযোগিতা করেছেন এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. আব্দুল আজিজ সার্বক্ষনিক খোঁজ খবর নিচ্ছেন এবং সহযোগিতা করছেন।

তাড়াশ ইউএনও মেজবাউল করিম জানান, গৃহহীন ও ভূমিহীন তালিকায় খোদেজা খাতুনের নাম রয়েছে। একজন সৎ জনপ্রতিনিধির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যা যা করার তা করা হবে। দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে আমি নিজে হাসপাতালে গিয়ে আর্থিক সহযোগিতাসহ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি।  #



সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

জীবন যাত্রা বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই