তারিখ : ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার

সংবাদ শিরোনাম

বিস্তারিত বিষয়

বকশীগঞ্জে আনন্দ স্কুল নামে ব্যাপক অনিয়ম বছরে কয়েক কোটি টাকা লুটপাট

বকশীগঞ্জে আনন্দ স্কুল নামে ব্যাপক অনিয়ম বছরে কয়েক কোটি টাকা লুটপাট
[ভালুকা ডট কম : ১০ এপ্রিল]
ভূয়া শিক্ষার্থীর নাম ও সাইনবোর্ডসর্বস্ব স্কুল দেখিয়ে বকশীগঞ্জে আনন্দ স্কুলের নামে বছরে কয়েক কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। প্রাথমিক স্তরে ঝড়ে পড়া শিশুদের শিক্ষার আলো পৌছানোর কার্যক্রম ভেস্তে যেতে বসেছে। ঝড়ে পড়া শিশুরা অধরাই থাকছে। ফলে আনন্দ স্কুলের ঝড়ে পড়া শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
 
জানাগেছে, প্রাথমিক স্তরে ঝড়ে পড়া শিশুদের শিক্ষার আলো পৌছাতে সরকার বিশেষ ব্যবস্থাপনায় রিচিং আউট অব চিলড্রেন (রস্ক) প্রকল্পের বিশ্ব ব্যাংককের অর্থায়ানে পরিচালিত এসব আনন্দ স্কুলে শিক্ষার ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানাগেছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের রস্ক প্রকল্পে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য ২০১০ সালে বকশীগঞ্জে ৩০৭টি আনন্দ স্কুলের যাত্রা শুরু করে। অভিযোগে রয়েছে, বকশীগঞ্জে আনন্দ স্কুল প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে নামে বে-নামে সাইনবোর্ডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান দেয়া হয়। এরমধ্যে বিভিন্ন কারনে কমে ২৮১টি স্কুল রয়েছে।  এ বছর ২৪৭টি আনন্দ স্কুলের পাচঁ হাজার ৬১৯ জন শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহন করবে। বাকি ৩৪টি আনন্দ স্কুলের প্রায় বারো’শ শিক্ষার্থী চতুর্থ শ্রেণী পড়ছে। অভিযোগ উঠেছে, ২৮১টি আনন্দ স্কুলে কাগজে কলমে শিক্ষার্থী থাকলেও তাদের বেশীর ভাগই ভূয়া নাম ও স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

সরেজমিন ঘুরে জানাগেছে, উপজেলার ২৮১টি আনন্দ স্কুলের বেশীর ভাগই সাইনবোর্ডসর্বস্ব অস্তিত্বহীন। এলাকায় সাইনবোর্ডসর্বস্ব স্কুল দেখা গেলেও শিক্ষার্থী দেখে মেলেনি। স্কুলের অস্তিত্ব না থাকলেও নামসর্বস্ব সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেছে। আবার কোথাও স্কুল ঘরে রাখা হয়েছে খড় খোটা ও গরুর গাদা। বোঝার উপায় নেই,এখানে আনন্দ স্কুল চলছে। দুই একটি আনন্দ স্কুলে গুটি কয়েক শিক্ষার্থী থাকলে বাকি সবকটি স্কুলের চিত্র খুবই ভয়াবহ। মূলত: আনন্দ স্কুলের কার্যক্রম কাগজে কলমে বাস্তবাবিত হচ্ছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখাগেছে উপজেলার মেরুরচর ইউনিয়নের টুপকাচর গ্রামে রোমানের বাড়ি আনন্দ স্কুল দেখতে গেলে শিক্ষিকা রুপালী বেগম শিক্ষার্থীদের পাঠদান না করে বাড়ির কাজ করছেন। তার বতসঘরে বারিন্দায় চট বিছানো শিক্ষার্থী নেই। খবর পেয়ে শিক্ষিকা রুপালি বেগম নিজেই ছোটা ছোটি করে শিক্ষার্থী জোগার করতে বের হন। আধা ঘন্টা পর তিন শিক্ষার্থীকে নিয়ে আসেন। তাদের ক্লাশ করতে বারিন্দায় চটে বসতে দেয়া হয়। তিনি জানান তার স্কুলে সমাপনী ১৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। খোজঁ নিয়ে জানাগেছে তারা পাশেই টুপকারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে। কথা হলো শিক্ষার্থী সুমি, জিয়া, পাপলুর সাথে তারা জানায়, চার বছরে কোন শিক্ষা উপকরন, পোশাক, উপবৃত্তির কোন টাকা পায়নি। এই নিয়ে শিক্ষিকা রুপালি বেগম জানায়, ৪ মাস পর পর বেতন দেয়ার কথা থাকলেও ৮ মাস পর চার মাসের বেতন পাওয়া যায়। এতকষ্টে পড়ালেখা করানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ, পোশাক, উপবৃত্তির কোন টাকা দেয়না। তারা শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে পারছেনা।

পৌর শহরের তিনানীপাড়া এলাকায় বস্তির ভিতরে দেখা গেল রহমত আলীর বাড়িতে আনন্দ স্কুল। সাইনবোর্ড নেই, তবে স্কুল শিক্ষিকা রহিমা বেগম থাকার ঘরের মেঝেতে স্কুল ঘর বানিয়ে ক্লাশ নেয়। শ্রেনী কক্ষে মেঝেতে রাখা হয়েছে রান্না বান্নার আসবাবপত্র। এখানে পড়ার কোনও পরিবেশ নেই। পাঠদানের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষিকা রহিমা বেগমের কোন উত্তর নেই। পরে অনেক চেষ্টায় ৪ জন শিক্ষার্থী পাওয়া গেল। শিক্ষার্থীরা জানায়, এই স্কুলে খাতা কলম, পোশাক ও উপবৃত্তির টাকা তারা কখনও পায়নি। ওই স্কুলের শিক্ষার্থী আখির অভিভাবক বুলবুলি বলেন, এটা আনন্দ স্কুল না তো নেতাদের টাকা খাওয়ার স্কুল। অপর শিক্ষার্থী নিপা মনির অভিভাবক ইয়াসমিনা বেগম জানায় আমরা গরীর মানুষ এমনিতে পড়াতে পারিনা। আনন্দ স্কুলে পড়লে পোশাক, খাতা কলম, উপবৃত্তি টাকা দেব। কিন্তু গত চার বছরে এক টাকাও পাায়নি। শুনেছি উপজেলা চেয়ারম্যানসহ আওয়ামীলীগ নেতারা টাকা খাইয়ে ফেলছে।

সরেজমিনে পরিদশর্নে গিয়ে বকশীগঞ্জ উপজেলার সবকটি আনন্দ স্কুলের এমন চিত্র দেখা মেলেছে। উপজেলার সূর্যনগর মধ্যপাড়া আজিজের বাড়ি আনন্দ স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ১৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। স্কুল কক্ষে রাখা হয়েছে জ্বালানির জন্য খড় কোটা ও গো-খাদ্য। এখানেও পড়ার কোন পরিবেশ নেই। সূর্যনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী সেতু, তিশা ও শিলা জানায়, তারা আনন্দ স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। আনন্দ স্কুলের পোশাক ও উপবৃত্তির টাকা তারা কখনও পায়নি। খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, সূর্যনগর গ্রামে আনন্দ স্কুল পাঁচটি। সাইনবোর্ডসর্বস্ব স্কুলঘর থাকলেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সূর্যনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।

জানাগেছে,আনন্দ স্কুলের শিক্ষার্থীদের পোশাক, শিক্ষা উপকরণ, পরীক্ষা ফি ও উপবৃত্তির টাকা দেয়ার নিয়ম থাকলেও শিক্ষার্থীরা তা পায়না। আনন্দ স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা না পাওয়ার বিষয়ে বকশীগঞ্জ সোনালী ব্যাংক ব্যবস্থাপক একেএম আযহারুল ইসলাম অস্বীকার করে বলেন শিক্ষার্থী অভিভাবকদের সুবিধার্থে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি কেন্দ্র স্থাপন করে শিক্ষা অফিস ও টিসি উপস্থিতি উপবৃত্তির টাকা বিতরন করা হয়। ব্যাংক ম্যানেজারের এমন উদ্ভট কথা অস্বীকার করে শিক্ষার্থী অভিভাবকরা বলেন ব্যাংক ম্যানেজারের দুর্নীতি অপকর্মের ঘটনা ধামাচাপা দিতে অবাস্তব ডাহা মিথ্যা কথা বলেছে।  ব্যাংকের একটি সূত্রে জানায়, আনন্দ স্কুলের উপবৃত্তির টাকা স্কুল কেন্দ্রে না গিয়ে ব্যাংকে বসে নিজেরাই টিপসই দিয়ে সিন্ডিকেটে ভাগ বাটোয়ারা করে আত্নসাত করছে। এমনকি তারা শিক্ষিকার বেতনের টাকা থেকেও কর্তন কারার অভিযোগ রয়েছে।

আনন্দ স্কুলের অন্ত:পক্ষে শতাধিক শিক্ষিকার সাথে কথা বলে জানাগেছে,তারা বলেন আনন্দ স্কুল পরিচালনা করতে তাদের অনিয়ম হয়েছে। তবে নাম না প্রকাশ করার শর্তে তারা অভিযোগে জানান, তাদের দূর্বলতাকে পুঁজি করে উপজেলা শিক্ষা কমিটি স্থানীয় কতিপয় আওয়ামীলীগের কমিশন নেতা ও বকশীগঞ্জ সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসূত্রে একটি সিন্ডিকেট ব্যাংকের স্বাক্ষরযুক্ত ব্লেঙ্ক চেকের মাধ্যমে আনন্দ স্কুলের নামে বরাদ্দকৃত বছরে কয়েক কোটি টাকা ইচ্ছামতো তছরুপ করছে। এভাবে বকশীগঞ্জে আনন্দ স্কুলের নামে বিশ্ব ব্যাংকের টাকা হরিলুট হচ্ছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের রস্ক প্রকল্পের আওতায় আনন্দ স্কুলের তদারকির করা আমার দায়িত্ব না। তিনি বলেন বকশীগঞ্জ উপজেলায় এ প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন কো-অর্ডিনেটর আবু হানিফ। কো-অর্ডিনেটর আবু হানিফের সাথে গত কয়েকদিন মোবাইলে যোগাযোগ চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এই বিষয়ে ইউএনও এরশাদ হোসেন খান জানান, তিনি বকশীগঞ্জ উপজেলায় নতুন যোগদান করেছেন। তাই আনন্দ স্কুল সম্পর্কে ভাল ধারনা নেই। তবে লুটপাটের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।



সতর্কীকরণ

সতর্কীকরণ : কলাম বিভাগটি ব্যাক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য,আমরা বিশ্বাস করি ব্যাক্তির কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতায় তাই কলাম বিভাগের লিখা সমূহ এবং যে কোন প্রকারের মন্তব্যর জন্য ভালুকা ডট কম কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় । প্রত্যেক ব্যাক্তি তার নিজ দ্বায়ীত্বে তার মন্তব্য বা লিখা প্রকাশের জন্য কর্তৃপক্ষ কে দিচ্ছেন ।

কমেন্ট

শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

অনলাইন জরিপ

  • ভালুকা ডট কম এর নতুন কাজ আপনার কাছে ভাল লাগছে ?
    ভোট দিয়েছেন ৮৯০৭ জন
    হ্যাঁ
    না
    মন্তব্য নেই